এক বা একাধিক ধ্বনি বা বর্ণ মিলে কোনো অর্থ প্রকাশ করলে তাকে শব্দ বলে। অর্থবোধক ধ্বনি ও ধ্বনি সমষ্টিকে শব্দ বলা হয়। বাক্যের মৌলিক উপাদান শব্দ। শন্দকে বাক্যের একক বলা হয় অর্থাৎ বাক্যের বাহন হলো শব্দ । শব্দের অর্থযুক্ত ক্ষুদ্রাংশকে রূপ বলে।
শব্দগঠনঃ শব্দের অর্থ-বৈচিত্র্যের জন্যে নানাভাবে তার রূপান্তর সাধন করা হয়। এভাবে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্যে শব্দ তৈরি করার প্রক্রিয়াকে এক কথায় শব্দগঠন বলে ।
শব্দ গঠনের প্রধান উপায়ঃ শব্দ গঠনের প্রধান উপায় তিনটি- উপসর্গ যোগে, প্রত্যয় যোগে ও সমাসের সাহায্যে । এছাড়াও আরো কয়েকটি প্রক্রিয়ার কথা ব্যাকরণে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
উপসর্গ যোগেঃ শব্দের আগে উপসর্গ যোগ করে । যেমন- আ + হার = আহার ।
প্রত্যয় যোগেঃ শব্দের শেষে প্রত্যয় যোগ করে । যেমন- ঢাকা + আই =ঢাকাই।
সমাসের সাহায্যেঃ সমাসের সাহায্যে একাধিক শব্দকে এক শব্দে পরিণত করে । যেমন- চো
রাস্তার সমাহার = চৌরাস্তা ।
সন্ধির সাহায্যেঃ সন্ধির সাহায্যে নতুন শব্দ গঠিত হয় । যেমন- বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়।
দ্বিরুক্তির সাহায্যেঃ নতুন শব্দ গঠিত হয় । যেমন-ঝির ও ঝির =ঝিরঝির । পদ পরিবর্তনের সাহায্যেঃ পদ পরিবর্তনের সাহায্যে নতুন শব্দ গঠিত হয় । যেমন- মানব" (বিশেষ্য) = মানবিক (বিশেষণ)।
শব্দের শ্রেণি-বিভাগ-
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দের শ্রেণি-বিভাগ হতে পারে । যেমন-
ক) গঠনমূলক
খ) অর্থমূলক
গ) উৎসমূলক
গঠনমূলক ভাবে শব্দ দুই প্রকার-
মৌলিক শব্দঃ যেসব শব্দ ষিশ্রেষণ করা যায় না বা ভেঙ্গে আলাদা করা যায় না, সেগুলোকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন- গোলাপ, ফুল, নাক, লাল, তিন ইত্যাদি ।
সাধিত শব্দ : যে সকল শব্দকে বিশ্লেষণ করা হলে আলাদা অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায়, সেগুলোকে সাধিত শব্দ বলে । সাধারণত একাধিক শব্দের সমাস হয়ে কিংবা প্রত্যয় থা উপসর্গ যোগ হয়ে সাধিত শব্দ গঠিত হয়ে থকে।
যেমন-
ডুবুরি (ডুব +উরি) .
চলন্ত (চল্ + অন্ত)
প্রশাসন( প্র + শাসন)
গরমিল (গর + মিল)
শীতল (শীত + ল)
গৌরব (গুরু + ষ্ণ
নেয়ে নো + ইয়া)
চাঁদমুখ (চাঁদ মতো মুখ)
নীলাকাশ (নীল যে আকাশ) ইত্যাদি ।
শব্দার্থ অনুসারে শ্রেণিবিভাগ
শব্দার্থ অনুসারে বাংলা ভাষার শন্দসমূহ তিন ভাগে বিভপ্ত | যথা
ক) যৌগিক শব্দ: যে সকল শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ একই রকম, সেগুলেকে যৌগিক শব্দ বলে । যেমন- দৌহিত্র, সাংবাদিক, গায়ক. মধর. মিতালি ইতাদ।
খ) রূঢ়ি শব্দ : যে সকল শব্দ প্রত্যয় বা উপসর্গযোগে মূল শব্দের অর্থের অনুগামী না হয়ে অন্য বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, তাকে রূঢ়ি শব্দ বলে । যেমন- হস্তী, বাঁশি, তৈল, প্রবীণ, সন্দেশ ইত্যাদি । .
উদাহরণঃ
হস্তী : হস্ত + ইন । অর্থ- হস্ত আছে যার; কিন্তু হস্তী বলতে একটি পশুকে বোঝায় ।
গবেষণা : (গো + এষণা) অর্থ-গরু খোজা । গভীরতম অর্থ অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা ।
বাঁশি: বাঁশদিয়েতৈরি যে কোনো বস্তু নয়, শব্দটি সুরের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র, বিশেষ অর্থে প্রযুক্তহয় ।
তৈল : শুধু তিলজাত গ্নেহ পদার্থ নয়, শব্দটি যে কোনো উদ্ভিজ্জ পদার্থজাত গ্নেহ পদার্থকে বোঝায় । যেমন- বাদাম তেল।
প্রবীণ : শব্দটির অর্থ হওয়া উচিত ছিল প্রকৃষ্টরূপে বীণা বাজাতে পারেন যিনি । কিন্তু শব্দটি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বয়স্ক ব্যক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
সন্দেশ : শব্দ ও প্রত্যয়গত অর্থে সংবাদ । কিন্ত রূঢ়ি অর্থে মিষ্টান্ন বিশেষ ।
গ) যোগরূঢ় শব্দ : সমাস নিষ্পন্ন যে সকল শব্দ সম্পূর্ণ ভাবে সমস্যমান পদসমূহের অনুগামী না হয়ে কোনো বিশিষ্ট অর্থ গ্রহণ করে, তাদের যোগরূঢ় শব্দ বলে । যেমন- পঙ্কজ, রাজপুত, জলদ, আদিত্য, তুরঙ্গম, চাঁদমুখ, সুহ্নদ ইত্যাদি।
উদাহরণ :পঙ্কজ: পক্ষে জন্মে যা (উপপদ ততৎপুরুষ সমাস) । শৈবাল, শালুক, পদ্মফুল প্রভৃতি নানাবিধ উদ্ভিদ পঙ্কে জন্মে থাকে । কিন্ত পঙ্কজ শব্দটি একমাত্র পদ্মফুল অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তাই পঙ্কজ একটি যোগরূটু শব্দ।
রাজপুত : রাজার পুত্র অর্থ পরিত্যাগ করে যোগরূঢ় শব্দ হিসেবে অর্থ হয়েছে জাতি বিশেষ ।
মহাযাত্রা : মহাসমারোহে যাত্রা অর্থ পরিত্যাগ করে যোগরঢ় শব্দ রূপে অর্থ মৃত্যু । .
জলধি : জল ধারণ করে এমন অর্থ পরিত্যাগ করে একমাত্র সমুদ্র অর্থেই ব্যবহৃত হয়।
শব্দের উৎস মূলক শ্রেণি-বিভাগ
বুৎপত্তিগতভাবে বা উৎস বিচারে বাংলা ভাষার শব্দকে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
বাংলা ভাষায় বিভিন্ন শব্দের অনুপাত
ক) তৎসম শব্দ
২৫%
বাংলা
খ) অর্ধ-তৎসম
০৫%
৭৫%
গ) তদ্ভব শব্দ
৬০%
ঘ) দেশি শব্দ
০২%
ঙ) বিদেশি শব্দ
০৮%
মোট
১০০%
ক) তৎসম শব্দ ঃ তৎসম শব্দ বলতে বুঝায় সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত ভাষা থেকে যেসব শব্দ সোজাসুজি বাংলায় এসেছে ও যাদের রূপ অপরিবর্তিত রয়েছে, সেসব শব্দকে তৎসম শব্দ বলে।
তৎসম অর্থ তার (তৎ) সমান (সম)।
সংস্কৃত ভাষার শব্দ থেকে বিভিন্ন বাংলা শব্দের উৎপত্তি
সংস্কৃত ভাষার শব্দ
পরিবর্তিত বাংলা শব্দ
দধি
দই
শাঢী
শাড়ি
খ) তদ্ভব শব্দ : যে সব শব্দের মূল সংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায়, কিন্তু ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তনের ধারায় প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলায় স্থান করে নিয়েছে, সে সব শব্দকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ। এই তদ্ভব শব্দগুলোকে খাঁটি বাংলা শব্দও বলে। “তদ্ভব" এর অর্থ হলো তা থেকে উৎপন্ন , তা মানে সংস্কৃত। যেমন- আকাশ. বাতাস, চাঁদ, চামার, পাঁখি, হাত, পা, মা, ভিটা, বাছা, পুস্তক,পাতা ইত্যাদি।
তৎসম শব্দ থেকে তদ্ভব শব্দের উৎপত্তি
সংস্কৃত
প্রাকৃত
তদ্ভব
হস্ত
হত্থ
হাত
পাদ
পাঅ
পা
চর্মকার
চম্ময়ার
চামার
চন্দ্র
চন্দ
চাঁদ
মাতা
মাআ
মা
ঘৃত
ঘিঅ
ঘি
গ) অর্ধ-তৎ্সম শব্দ : বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে ব্যবহৃত হয় এগুলোকে অর্ধ-তৎ্সম শব্দ বলে অর্থাৎ বাংলা ভাষায় অর্থ-তৎসম শব্দগুলো এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে । যেমন- খিদে,গিন্নি , গেরাম,জোছনা,কেষ্ট,মিষ্টি,ছেরাদ্দ,কুচ্ছিত,বোষ্টম,তেষ্টা, ষাঁড় ইত্যাদি ।
ঘ) দেশি শব্দ : বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীদের (যেমন : কোল, খা গভৃতি) ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান বাংলায় রক্ষিত হয়েছে। এ সব শব্দকে দেশি শব্দ নামে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ অনার্য জাতির ব্যবহৃত শব্দকে দেশি শব্দ বলে।
ঙ) বিদেশি শব্দ : দে সকল শব্দ বিদেশ থেকে জামদানি হয়ে বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করেছে, সে শব্দ গুলোকে বিদেশি শব্দ বলে । রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বহু শব্দ বাংলায় এসে স্থান করে নিয়েছে । যেমন-
ফারসি /পারসি শব্দঃ বিদেশি শব্দের মধ্যে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি শব্দ এসেছে ফারসি শব্দ থেকে । যেমন-
১) ধর্ম সংক্পান্ত শব্দঃ খোদা, শুনাহ, দোজখ, নামায, রোযা, পয়গন্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, শিন্নী , হাদিস ইত্যাদি ।
২) প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক শব্দঃ কাগজ, কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, ফরমান, তোশক, দফতর, দফতর , দরবার ,দোকান , দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, মেধর, রসদ ইত্যাদি ।