রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আবুল কাশেম ফজলুল হক এ ক্ব ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মুহাম্মদ ওয়াজেদ এবং সাঈদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। ভারতের লক্ষ্মৌতে তাকে শেরেবাংলা উপাধি দেওয়া হয়। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার মধ্যে কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রথম মূখ্যমন্ত্রী, পুর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অন্যতম। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বিখ্যাত বাঙ্গালী রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। ১৮৯২ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠিত করেছেন তার মধ্যে কলকাতার ডেপুটি মেয়র, অবিভক্ত বাংলার শেষ মূখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অন্যতম। ১৯৬৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মৃত্যুবরণ করেন। আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) জাতির জনক এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি (২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২)। শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। মুজিব ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। তিনি স্থানীয় গীমাডাঙ্গা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। চোখের সমস্যার কারণে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর ব্যাহত হয়। ১৯৪২ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন। স্কুল জীবন থেকেই মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলের ছাত্র সে সময় একবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক ঐ স্কুল পরিদর্শনে আসেন (১৯৩৯)। শোনা যায়, ঐ অঞ্চলের অনুন্নত অবস্থার প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তরুণ মুজিব বিক্ষোভ সংগঠিত করেন। ম্যাট্রিক পাশের পর মুজিব কলকাতায় গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি আই.এ ও বি.এ পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এইচ. এস সোহরাওয়ার্দীর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শেখ মুজিবকে ফরিদপুর জেলায় দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব অপর্ণ করে। ভারত বিভাগের (১৯৪৭) পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। তবে পড়াশুনা শেষ করতে পারেন নি। কারণ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে প্রধান সংগঠকদের একজন ছিলেন শেখ মুজিব। বস্তুত জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৪৯) যুগ্ম সম্পাদকের তিনটি পদের মধ্যে একটিতে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। অপর দুই যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ.কে রফিকুল হোসেন। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬৬ সালেই তিনি দলের সভাপতি হন। দলকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র দেওয়ার জন্য ১৯৫৫ সালে মুজিবের উদ্যোগে দলের নাম হতে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের পর রাজনীতিতে তাঁর যে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটেছিল এ ছিল তারই প্রতিফলন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় (১৯৫৬-৫৮) মাত্র নয় মাস কাজের পর মন্ত্রীপদে ইস্তফা দেন। ১৯৬৪ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনামলে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার মতো সাহসিকতা দেখিয়েছেন শেখ মুজিব, যদিও তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ রেখে পাকিস্তানে সাংবিধানিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক মোর্চার ব্যানারে কাজ করার সপক্ষে ছিলেন। পাকিস্তান ধারণাটির ব্যাপারে ইতোমধ্যেই মুজিবের মোহমুক্তি ঘটেছিল। পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদ ও আইনসভার সদস্য (১৯৫৫-১৯৫৬) এবং পরবর্তীতে জাতীয় পরিষদের সদস্য (১৯৫৬-১৯৫৮) হিসেবে তাঁর এমন ধারণা হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মনোভাবের মধ্যে সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ব বোধ ছিল না। শেখ মুজিব ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদের একজন (১১ মার্চ ১৯৪৮)। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার প্রশ্নে তাঁর প্রদত্ত ভাষণ ছিল উল্লেখযোগ্য। মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার অধিকার দাবি করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখানে বাংলায় কথা বলতে চাই। আমরা অন্য কোনো ভাষা জানি কি জানি না তাতে কিছুই যায় আসে না। যদি মনে হয় আমরা বাংলাতে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি তাহলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা সত্ত্বেও আমরা সবসময় বাংলাতেই কথা বলব। যদি বাংলায় কথা বলতে দেওয়া না হয় তাহলে আমরা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যাবো। কিন্তু পরিষদে বাংলায় কথা বলতে দিতে হবে। এটাই আমাদের দাবি।’ ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট গণপরিষদে প্রদত্ত আরেক ভাষণে শেখ মুজিব পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার প্রতিবাদে যে বক্তব্য রাখেন তাও সমভাবে প্রাসঙ্গিক: ‘স্যার, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, তারা পূর্ববঙ্গের স্থলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বসাতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়ে এসেছি যে, [পূর্ব] পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের পূর্ব [বঙ্গ] ব্যবহার করতে হবে। ‘বঙ্গ’ শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য...’। বিশ শতকের ষাটের দশকের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে প্রাধান্য লাভ করেন। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার দ্বারা শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে আন্তঃদলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত করে দলের মূল স্রোত থেকে কিছু কিছু উপদলের বেরিয়ে যাওয়া রোধ করতে সক্ষম হন। সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন সংগঠক শেখ মুজিব দলের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন এবং এই ছয় দফাকে আখ্যায়িত করেন ‘আমাদের (বাঙালিদের) মুক্তি সনদ’ রূপে। দফাগুলো হলো : ১. ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন এবং সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন; ২. প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যতীত অপর সকল বিষয় ফেডারেটিং ইউনিট বা প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে ন্যস্ত করা; ৩. দুই রাষ্ট্রের জন্য পৃথক মুদ্রা চালু করা অথবা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; ৪. করারোপের সকল ক্ষমতা ফেডারেটিং রাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করা; ৫. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান; ৬. রাষ্ট্রসমূহকে নিজের নিরাপত্তার জন্য মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা প্রদান করা। সংক্ষেপে এ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে রাজনীতির প্রতি তাঁর এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গী উন্মোচিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ছয়-দফা কর্মসূচীর অর্থ ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতা। সকল রাজনৈতিক দলের রক্ষণশীল সদস্যরা এ কর্মসূচীকে আতঙ্কের চোখে দেখলেও এটা তরুণ প্রজন্ম বিশেষত ছাত্র, যুবক এবং শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে নূতন জাগরণের সৃষ্টি করে। মুজিব কর্তৃক ছয়দফা কর্মসূচীর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পর আইয়ুব সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। শেখ মুজিব এবং আরও চৌত্রিশ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়। সরকারিভাবে এ মামলাটির নাম দেয়া হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। মামলায় অভিযুক্তদের অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তান বিমান এবং নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসার এবং কর্মচারী। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন উর্দ্ধতন বাঙালি বেসামরিক কর্মকর্তা। মুজিব ইতোমধ্যে কারারুদ্ধ থাকায় তাঁকে এক নম্বর আসামী হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ মামলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি অন্যান্য আসামীর যোগসাজশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। অভিযোগ মতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য আসামী ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন করার গোপন পরিকল্পনা করছিলেন। পাল্টা আঘাত হানার এ চালটি অবশ্য বুমেরাং হয়েছিল। ঢাকা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলাটির বিচার চলছিল যেটা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের আধিপত্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আবেগ অনুভূতিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের সময় মুজিবের জনমোহিনী রূপ আরোও বিকশিত হয় এবং সমগ্র জাতি তাদের নেতার বিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের দ্বারা সংগঠিত গণআন্দোলন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে আইয়ুর সরকার দেশে আসন্ন একটি গৃহযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টায় মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। শেখ মুজিব ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন। শেখ মুজিবের মুক্তির পরবর্তী দিন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিবের সম্মানে গণসম্বর্ধনার আয়োজন করে। এ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানে সরকারকে বাধ্য করার ব্যাপারে সবচাইতে কার্যকর রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তি বলে প্রমাণিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মুজিবের মধ্যে তারা এমন একজন ত্যাগী নেতার প্রতিফলন দেখতে পান যিনি ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলের প্রায় বারো বছর জেলে কাটিয়েছেন। বারো বছর জেলে এবং দশ বছর কড়া নজরদারীতে থাকার কারণে শেখ মুজিবের কাছে পাকিস্তানকে নিজের স্বাধীন বাসভূমির পরিবর্তে বরং কারাগার বলেই মনে হতো। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সাতটি আসন সহ) জয়লাভ করে। আপামর জনগণ তাঁকে ছয়দফা মতবাদের পক্ষে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট প্রদান করে। ছয় দফা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাঁর উপরই বর্তায়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রমনা রেসকোর্সে একটি ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং শপথ নেন যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় তারা কখনও ছয়দফা থেকে বিচ্যুত হবেন না। এ পরিস্থিতিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে না দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এক ঘোষণায় ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত করেন। এ ঘোষণার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সমগ্র প্রদেশ তাঁকে সমর্থন জানায়। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে (২-২৫ মার্চ ১৯৭১) পূর্ব পাকিস্তানের গোটা বেসামরিক প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং তাঁর নির্দেশমত চলে। তিনি কার্যত অর্থে প্রাদেশের সরকার প্রধান হয়ে যান। লন্ডনের দৈনিক Evening Standard পত্রিকার ভাষায়: ‘জনতার পুরোপুরি সমর্থন পেয়ে শেখ মুজিব যেন পূর্ব পাকিস্তানের কর্তৃত্বে সমাসীন হন। (মুজিবুর) রহমানের ধানমন্ডির যে বাড়ি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের অনুকরণে ইতোমধ্যে ১০ ডাউনিং স্ট্রীটের মতো পরিচিতি লাভ করেছে তা আজ আমলা, রাজনীতিক, ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের দ্বারা অবরুদ্ধ।’ (১২ মার্চ ১৯৭১) ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের বিশাল জমায়েতে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে যুগ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। মুজিব তাঁর ভাষণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আনেন। বক্তৃতার শেষে মুজিব ঘোষণা করেন: ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে... মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দলের সাথে আলোচনা শুরু করতে ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরদিন থেকে আলোচনা শুরু হয়, যা মাঝেমধ্যে বিরতিসহ ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে। এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন এবং লাগাতার হরতাল চলছিল। মার্চের ২ তারিখ থেকে ছাত্র এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকেন এবং এ ধারা অব্যাহতভাবে চলে। এ পটভূমিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক তান্ডব চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষক এবং নিরীহ লোকদের গণহারে হত্যা করে। এভাবে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস ধরে গণহত্যা চালিয়ে যায়। শেখ মুজিবকে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিদ্রোহে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তা সম্প্রচারের জন্য ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে এক ওয়্যারলেস বার্তা পাঠান। তাঁর ঘোষণাটি নিম্নরূপ: ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর হামলার পর থেকে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয় সে সময় বঙ্গবন্ধু যদিও পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী ছিলেন তথাপি তাঁকে তাঁর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকার নামে অভিহিত অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিরা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠন করে। তাঁকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কও করা হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের গোটা অধ্যায়ে শেখ মুজিবের অনন্য সাধারণ ভাবমূর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা এবং জাতীয় ঐক্য ও শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানি জান্তা বঙ্গবন্ধুর বিচার করে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিলে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাঁর জীবন বাঁচাতে উদ্যোগী হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদারী থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি কারাগার হতে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন হয়ে বিজয়ীর বেশে স্বদেশ প্রর্ত্যাবর্তন করেন। সারা দেশে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়। সমাজের সর্বস্তরের লাখো জনতা তেজগাঁ পুরাতন বিমানবন্দরে তাঁকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানায়। নতুন প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বকে ঘিরে এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে যে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ জমে উঠেছিল তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তা তিরোহিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল : ‘শেখ মুজিব ঢাকা বিমানবন্দরে পর্দাপণ করা মাত্র নতুন প্রজাতন্ত্র এক সুদৃঢ় বাস্তবতা লাভ করে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে প্রথম সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত সময়টুকু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। শূণ্য থেকে শুরু করে তাঁর সরকারকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের অগণিত সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং জাতিগঠন কার্যক্রম শুরু হয়। আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃনির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের জনরোষ থেকে রক্ষা করা এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা এবং আরো অনেক সমস্যার সমাধান তাঁর সরকারের সামনে সুবিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতসব সমস্যা সত্ত্বেও শেখ মুজিব একটি নূতন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে কখনই দ্বিধাগ্রস্ত হননি এবং সে কাজটি তিনি দশ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করেন। স্বাধীনতার তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা হয়। পনেরো মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (৭ মার্চ ১৯৭৩)। একশত চল্লিশটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির পথনির্দেশনা নির্ধারণ করেন : ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়।’ বাস্তবিকপক্ষে মুজিব সরকার গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্রে মৌলিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সূচনা করেন। এতসব অর্জন সত্ত্বেও মূলত উগ্র বামপন্থীদের তরফ থেকে বিরোধিতা আসে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকে একটি ‘অসম্পূর্ণ বিপ্লব’ বলে গণ্য করে অস্ত্র ধারণ করে। ফলে দেশে একটি চরম নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। সর্বোপরি দেশে দুর্ভিক্ষ (১৯৭৪) দেখা দেয় এবং হাজার হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। শেখ মুজিব প্রথমে রক্ষীবাহিনী নামে একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করেন। নিজের জনমোহিনী ভাবমূর্তিকে আশ্রয় করে তিনি এরপর বাকশাল নামে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেন এবং শাসনতন্ত্রে যেসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে সেগুলি খর্ব করেন। পরিণামে শেখ মুজিব অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং সকল মহলের সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত হন। এরকম একটা অস্থিতিশীল অবস্থার সুযোগ নিয়ে একদল সংক্ষুব্ধ সেনাসদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে এবং পরিবারের অন্য যেসব সদস্য তাঁর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তাদের সবাইকে হত্যা করে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমান শৈশবে কিছুকাল বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে এবং কিছুকাল কলকাতায় অতিবাহিত করেন। ভারত বিভাগের (১৯৪৭) পর তাঁর পিতা করাচীতে বদলি হলে জিয়াউর রহমান কলকাতার হেয়ার স্কুল ছেড়ে করাচীর একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচীর ডি.জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।জিয়াউর রহমান ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। এ পদে তিনি দুই বছর চাকরি করেন এবং ১৯৫৭ সালে তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীতেও কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য তাঁর কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। ঐ বছরই একটি ‘কমান্ড’ কোর্সে যোগদানের জন্য তাঁকে কোয়েটার স্টাফ কলেজে পাঠানো হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে দ্বিতীয়-অধিনায়ক পদে দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি পশ্চিম জার্মানি থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে দেশে ফিরে আসার পর জিয়াউর রহমানকে (তদানীন্তন মেজর) অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয়-অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। স্বভাবতই জনসাধারণের কাছে জিয়াউর রহমান নামটি অপরিচিত ছিল। কিন্তু তিনি একজন তাৎক্ষণিক জাতীয় ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হলেন যখন তিনি ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তাঁর ঘোষণাটি ছিল: ‘‘আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক, এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। ‘‘আমি আরও ঘোষণা করছি, আমরা ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও বৈধ সরকার গঠন করেছি। এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন এবং শাসনতন্ত্র মেনে চলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সরকার সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বের প্রত্যাশী এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য চেষ্টা করবে। আমি সকল সরকারের কাছে আবেদন করছি তারা যেন বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ দেশে জনমত গড়ে তোলেন। ‘‘শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে গঠিত সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও বৈধ সরকার এবং এই সরকার পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতি লাভের অধিকার সংরক্ষণ করে।’’ জিয়াউর রহমান এবং তাঁর সেনাবাহিনী এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে পুরোভাগে চলে আসে। মেজর জিয়া এবং তাঁর সশস্ত্রবাহিনী বেশ কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগত কারণে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে। মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং যুদ্ধ পরিচালনায় জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১ নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে এবং পরে ‘জেড’ ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান নিজেকে অসম সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করে তোলেন এবং সাহসিকতার জন্য তাঁকে ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। নয় মাস যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার পর জিয়াকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। ১৯৭২ সালের জুন মাসে তাঁকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষ নাগাদ মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট জিয়াউর রহমান চীফ অফ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় খালেদ মোশাররফ যখন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান, তখন জিয়াউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতা বিপ্লব তাঁকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করা হয়। একই দিনে সেনাসদরে এক বৈঠকে অন্তবর্তীকালীন সরকার পরিচালনার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এম.জি তাওয়াব ও রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. এইচ খানকে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর জাস্টিস সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়াউর রহমান এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অবশেষে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্র প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এক সরকারি ঘোষণা দ্বারা সংবিধানে সংশোধনী এনে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু, দয়াময় আল্লাহর নামে) সংযোজন করেন। সংবিধানের ৮(১) এবং ৮ (১ক) অনুচ্ছেদে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাটি যোগ করা হয়। ৮(১) অনুচ্ছেদে সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৫(২) অনুচ্ছেদে যোগ করা হয়, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামে একটি নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাদেশে বহু সংখ্যক বিভিন্ন মতের ও ধর্মের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরণ বিভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, শুধুমাত্র ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখন্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। তদুদ্দেশ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। পুলিশের সংখ্যা আগের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ করে (৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০) তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তাদের সংখ্যা ১৯৭৪-৭৫ সালের পঞ্চাশ হাজারেরও কম থেকে ১৯৭৬-৭৭ সালে প্রায় নববই হাজারে উন্নীত করেন। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও জিয়াউর রহমানকে বেশ কয়েকটি সেনা বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যারা অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। একটি বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান কঠোর ও দৃঢ় অবস্থান নেন। তাঁর মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মে যে, যত দ্রুত দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তিত হবে ততই তা হবে তাঁর নিজের ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক। এতদুদ্দেশ্যে তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন ব্যবস্থার পুনর্বহাল করেন এবং এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা সহজতর করেন। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি নিষিদ্ধ ও ছত্রভঙ্গ রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনরুজ্জীবনের সুযোগ করে দেন এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অনুমতি প্রদান করেন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে জিয়া সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং সংবাদ মাধ্যমকে স্বাধীন এবং হস্তক্ষেপহীন করে সংবাদ মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যমান পরিস্থিতি তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত করলে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালিত করার সুযোগ দিলে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি জাস্টিস আবদুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। জিয়ার মনে আরও সংস্কারের পরিকল্পনা ছিল। তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি নামে (বিএনপি) একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, এবং নিজে এ দলের চেয়ারম্যান হন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসনে জয়যুক্ত হয়। ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। শাসনতন্ত্রের পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। জিয়াউর রহমানের জন্য এটি একটি বিরাট সাফল্য যে তিনি নির্বাচনী রাজনীতি পুনর্বহাল করে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান অন্য একটি সেক্টরে বিশেষ অবদান রেখেছেন বলে দাবি করতে পারেন, সেটি হলো জাতীয় অর্থনৈতিক সেক্টর। জিয়ার অর্থনৈতিক নীতিমালা বেসরকারি সেক্টর উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করে যা এতদিন অবহেলিত ছিল। জিয়া একটি বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ করেন যাদের দায়িত্ব ছিল এমন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যার দ্বারা বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যেত এবং কৃষকদের ও কৃষি বাজারকে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি আনয়ন করা সম্ভব। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানাগুলোকে যে যে ক্ষেত্রে সম্ভব ভূতপূর্ব মালিকদের ফেরত দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধির জন্য তিনি প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জিয়ার অর্থনৈতিক নীতি তাঁর অনেক সাফল্য এনে দেয়। খাদ্য উৎপাদন একটা নতুন শিখরে পৌঁছে এবং অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি খাদ্য উদ্ধৃত্ত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। জিয়াউর রহমানের কর্ম পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচি। এই কর্মপরিকল্পনা দেশে দ্রুত আর্থসামাজিক পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনা এবং প্রবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় জনগণের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা ও গ্রামীণ উন্নয়ন সাধন করা। এ কর্মসূচির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং ব্যক্তিখাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশে অধিকতর উৎসাহ দান। জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং নারী, যুবক ও শ্রমজীবীদের বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী করেই এ কর্মসূচি প্রণীত হয়। এর লক্ষ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। জিয়া তাঁর অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশের রাজনীতিকে উন্নয়নমুখী রাজনীতিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেন যদিও তত্ত্বগতভাবে এ ধরণের স্বপ্ন ছিল নিঃসন্দেহে খুবই দুর্বল। সামাজিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্র শুধুমাত্র উৎপাদনকেই অন্তর্ভুক্ত করে না। এর অন্যান্য বহু শাখা রয়েছে। অবশ্য, তিনি যে কর্মসূচি গ্রহণ করেন সেটিকে তিনি আখ্যায়িত করেন একটি বিপ্লবরূপে এবং প্রবৃদ্ধির অভিযানে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে দলের লোকদের উদ্বুদ্ধ করেন। এসব কার্যক্রমের মধ্যে প্রথম ছিল খাল খনন, যার মাধ্যমে তিনি বিশেষ করে খরা মৌসুমে কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত সেচের পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। দ্বিতীয় কার্যক্রম ছিল সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা, যাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় প্রকার শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সর্বত্র এক আলোকিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া কারখানা ও ক্ষেত-খামারে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমও গৃহীত হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যানুকূল আয়তনে জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য জিয়া ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে একটি সাহসী উদ্যোগ হিসেবে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যেটা জিয়ার জন্য একটি সস্তা রাজনৈতিক ধারণাতে পরিণত হয়। জিয়ার কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এই যে, তার কর্মসূচি শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার একটা শ্লোগান ছিল না। তিনি আন্তরিকতার সাথেই তাঁর কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। দেড় বছরের মধ্যে দেড় হাজারেরও অধিক খাল খনন ও পুনর্খনন, পরপর দুই বছর (১৯৭৬-৭৭ ও ১৯৭৭-৭৮) খাদ্য শস্যের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন, ১৯৭৬-৭৮ সালে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪% অর্জন, ব্যাপক গণশিক্ষা কার্যক্রম, গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন জনমনে গভীর রেখাপাত করে। দাতা গোষ্ঠীও তাঁর সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের সঙ্গে সমতা-ভিত্তিক ও সুপ্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়া পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন। প্রথম তিনি জনগণের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্খা পুনরুজ্জীবিত করে দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করেন। অতঃপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগী শক্তিসমূহের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ স্থিতিশীল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্র নীতির উদ্দেশ্যসমূহকে পুনঃনির্ধারিত করা হয় এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে শান্তি এবং অগ্রগতি অর্জন করার লক্ষ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেয়া হয়। আঞ্চলিক পর্যায়ে পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে এবং ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, যে প্রচেষ্টা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্র থেকে প্রশংসা অর্জন করে। জিয়ার নেতৃত্বাধীনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব ধরণের অর্থাৎ দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সাথে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়। ফলশ্রুতিতে মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশ এবং এর সমস্যার দিকে নতুনভাবে দৃষ্টিপাত করে। চীন ও আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের একটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে। নানা দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন এবং অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। তাঁর এ উদ্যোগের ফলাফল ছিল আশাব্যাঞ্জক। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের একটি অস্থায়ী আসনে সদস্য নির্বাচিত হয় এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা উদ্ভাবন করেন এবং এ সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭৯-৮০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সফর করে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) তাঁরই প্রচেষ্টার ফসল। জিয়াউর রহমান তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেন নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। তাঁকে ঢাকার শেরেবাংলানগরে সমাহিত করা হয়। আবু তাহের কর্নেল আবু তাহের একজন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ) নেতা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এক হত্যা মামলায় সামরিক আদালতে তার মৃত্যুদন্ড হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাহেরকে ফাসি দেয়া হয়।
দুঃখিত । আপনি লগ ইন করেন নি। কোন প্রশ্ন কে পরিবর্তন করার জন্য প্রথমে আপনাকে লগ ইন করতে হবে।
দুঃখিত । আপনি লগ ইন করেন নি। কোন ব্যাখ্যা পরিবর্তন করার জন্য প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে।
বিষয়ভিত্তিক সমাধান
প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সমাধান
গুরুত্বপূর্ণ লিংক
আমাদের সিস্টেম ডেভেলপারগণ এই অপশন নিয়ে কাজ করছে । আগামী ৩১ মে অপশনটি শুভ উদ্বোধন করা হবে।
আর মাত্র
বাকি
আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ