মঙ্গলকাব্য রচনার মূল কারণ স্বপ্রদেবী কর্তৃক আদেশ লাভ। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বিশেষ এক শ্রেণির ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য হলো “মঙ্গলকাব্য ৷ “মঙ্গল' শব্দটির আভিধানিক অর্থ “কল্যাণ' । যে কাব্য দেবতার আরাধনা, মাহাত্ম্-কীর্তন করা হয়; যে কাব্য শ্রবণেও মঙ্গল হয় এবং বিপরীতটিতে হয় অমঙ্গল; যে কাব্য মঙ্গলাধার, এমন কি, যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়-তাকেই বলা হয় “মঙগলকাব্য' ৷ বাংলা সাহিত্যের নানা শ্রেণির কাব্যে মঙ্গল কথাটির প্রয়োগ থাকলেও কেবল বাংলা লৌকিক দেবতাদের নিয়ে রচিত কাব্যই মঙ্গলকাব্য নামে অভিহিত হয় । মঙ্গলকাব্যে সাধারণত মনসা ও চণ্ডী এই দুই দেবতার প্রাধান্য বেশি। এসর মঙ্গলকাব্যস্তলোতে বন্দনা, গ্রন্থ রচনার কারণ বর্ণনা, দেবখণ্ড, নরখণ্ড বা মূল কাহিনী বর্ণনা - মোটামুটি এই চার অংশ থাকতো । এছাড়া বারমাসী, চৌতিশা ও কবির পরিচয়ও উল্লেখ থাকতো । উল্লেখযোগ্য মঙ্গলকাব্য হলো- মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি । 'চৈতন্যমঙ্গল”, “গোবিন্দমঙ্গল' প্রভৃতি কাব্যের সঙ্গে মঙ্গল নাম থাকলেও এদের সাথে মঙ্গলকাব্যের কোনো যোগসূত্র নেই । এগুলো বৈষ্ণব সাহিত্যের অংশ । বিহারীলাল চক্রবতী রচিত “সারদামঙ্গল' মঙ্গলকাব্য নয়, এটি একটি আধুনিক যুগের কাব্য । মঙ্গলকাব্যগুলোকে শ্রেণিগত দিক থেকে দু'ভাগে ভাগ করা যায় –
(বা বিদ্যাসুন্দর), ষষ্ঠীমঙ্গল, সার্দামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল প্রভৃতি ।
মনসামঙ্গল
সাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা । তার অপর নাম কেতকা ও পদ্মাবতী । লৌকিক ভয়ভীতি থেকেই এ দেবীর উদ্ভব। এই দেবীর কাহিনী নিয়ে রচিত কাব্য “মনসামঙ্গল' নামে পরিচিত । কোথাও তা 'পদ্মাপুরাণ' নামেও অভিহিত হয়েছে। চাঁদ সদাগরের বিদ্রোহ ও বেহুলার সতীত্ত্ব কাহিনীর জন্য নারায়ণ দেব. বিক্রয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই. দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস, ক্ষেমানন্দের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ।
চন্ডীমঙ্গল
চন্ডী দেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্য এ দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল । মাণিক দত্ত চন্ডীমঙ্গলের আদিকবি। চন্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি 'কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবতী' ৷ ভাড়ুদত্ত, ধনপতি সদাগর প্রভৃতি চন্ডীমঙ্গলের প্রধান চরিত্র । ধনপতি সদাগর ছিলেন উজানীনগরের অধিবাসী ।
ধর্মমঙ্গল
ধর্মমঙ্গল” কাব্যের আদিকবি ময়ূরভট্ট। অন্যান্য কবিদের মধ্যে রুপরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, খেলারাম চক্রবর্তী, শ্যাম পণ্ডিত, সীতারাম দাস, রাজারাম দাস এবং সহদেব চক্রবর্তীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ধর্মঠাকুর নামে কোনো এক পুরুষ দেবতার পূজা হিন্দু সমাজের নিচু স্তরের লোকদের । মধ্যে বিশেষত ডোম সমাজে প্রচলিত রয়েছে। ধর্মঠাকুর প্রধানত দাতা, নিঃসন্তান নারীকে সন্তান দান জন্য “ধর্মমঙ্গল' কাব্য ধারার সূত্রপাত হয়েছে। ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনী হলো- রাজা হরিশ্চন্রের কাহিনী এবং লাউসেন্রে কাহিনী ।
অন্নদামঙ্গল
চণ্ডী ও অন্নদা অভিন্ন- একই দেবীর দুই নাম। এ দেবীর কাহিনীই অন্নদামঙ্গল স্থান পেয়েছে । ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর : অন্নদামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ভার্তচন্দ্র প্রায়শুণাকর । কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অষ্টাদশ শতকের তথা মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ট কবি। তিনি ছিলেন মঙ্গলযুগের সর্বশেষ কবি তথা বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি । ভারতচন্ত্র প্রাচীন ভুরসুর পরগনার পেড়ো অথবা আধুনিক হাওড়া জেলার পান্ডুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে তিনি তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি “অন্নদামঙ্গল' কাব্যটি রচনা করেন। ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যটি তিন খণ্ডে বিভক্ত। যথা- শিবনারায়ণ, কালিকামঙ্গল এবং মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান ।
“সত্য পীরের পাচালী' কবির অন্য একটি বিখ্যাত গ্রন্থ । ১৭৬০ ধ্রিস্টাব্দে কবি ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কাব্যের ইতিহাসে মঙ্গলযুগের তথা মধ্যযুগের অবসান ঘটে ।অন্নদামঙ্গল কাব্যের অমর উক্তি-
“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে”- ঈশ্বর পাটনী এ প্রার্থনা করেছিলেন ।
‘ বড়র পিরীতি বালির বাঁধ! ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেকে চাঁদ।