বাংলা ছন্দ : সংস্কৃত ভাষায় ছন্দ শব্দের অর্থ “কাব্যের মাত্রা" আরেক অর্থ “ইচ্ছা । ছন্দ শব্দের ব্যাপক অর্থ - গতি-সৌন্দর্য । মাত্রা-নিয়মেন যে বিচিতরতায় কাব্যের ইচ্ছাটি বিশেষভাবে ধ্বনি-রূপময় হয়ে ওঠে, তাকেই ছন্দ বলে। |
ঠাকুরের ভাযায়- কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যই ছন্দ। |
ছন্দের শ্রেণিবিভাগ : বাংল ছন্দ বা প্রথাগত ছন্দ প্রধানত তিন রকমের । যথা- স্বরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ,এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দ |
স্বরবৃত্ত ছন্দ : যে ছন্দে যুগ্মদ্বনি সব সময় একমাত্রা গণনা করা হয় এবং প্রত্যেক পর্বে প্রথম শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত পড়ে তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে। স্বরবৃত্ত ছন্দকে - দলবৃত্ত বা লৌকিক বা ছড়ার ছন্দ বা শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ বা প্রাকৃত বাংলার ছন্দ বলা হয়। ছেলে ভুলানো ছড়া সাধারণত স্বরবৃত্ত
ছন্দে লেখা হয়। যেমন-
শিব ঠাকুরের/ বিয়ে হলো/ তিন কন্যে/ দান। (মাত্রা : 8/8/৪/১) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বরবৃত্তের বৈশিষ্ট্য
মুল পর্বে মাত্রা সংখ্যা ৪।
এ ছন্দের লয় দ্রম্ত। .
যে কোনো অক্ষর (মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর) একমাত্রার ।
উদাহরণ : আড়াল =”আ (১) + ডাল (১) = ২ স্বর।
২) মাত্রাবৃত্ত ছন্দ : যে ছন্দে যুগ্মধ্বনি দুই মাত্রা গণনা করা হয় এবং বিশ্লিষ্ট ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়, তাকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে - কলাবৃত্র বা বর্ণবৃত্ত বা ধ্বনিপ্রধান ছন্দও বলা হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৬ মাত্রার পর্বই অধিক । চার, পাঁচ, সাত এবং আট মাত্রার পর্বও এ ছন্দে দেখা যায়।
যেমন- সোনার পাখি ছিল সোনার খাচাটিতে (মাত্রা : ৭ + ৭)
বনের পাখি ছিল/ বনে । (মাত্রা : ৭ + ২) - ববীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাত্রাবৃত্তের বৈশিষ্ট্য
মুল পর্বে মাত্রা সংখ্যা চার, পাচ, ছয়, সাত এবং আট মাত্রার । তবে এ ছন্দে ছয় মাত্রার প্রচলনই বেশি ।
এ ছন্দে বদ্ধাক্ষর সর্বদা দুই মাত্রার হয় |
উদাহরণ : আমারা =আম (১+১) + রা (১) = ৩ অক্ষর |
“আঠারো বছর বয়স' কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
৩) অক্ষরবৃত্ত ছন্দ : যে ছন্দে সর্বপ্রকার মুক্তাক্ষর একমাত্রাবিশিষ্ট এবং বদ্ধাক্ষর শব্দের শেষে দুই মাত্রা, কি শদের আদতে এবং মধ্যে একমাত্রা ধরা হয়, সে ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে -অক্ষরমাত্রিক বা কলামাত্রিক বা মিশ্রকলামাত্রিক বা যৌগিক ছন্দ প্রভৃতি বলা হয়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অপর নাম হলো “তানপ্রধান ছন্দ'। যেমন-
মানবের মাঝে আমি / ঝাটিবারে চাই। (মাত্রা : ৮ +৬) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অক্ষরবৃত্তের বৈশিষ্ট্য -
মুল পর্বে মাতা সংখ্যা ৮ বা ১০ মাত্রার হয়।
এ ছন্দে দয় ধীর বা মাধ্যম।
চালে শব্দের আদি ও মধ্যে বন্ধাক্ষর একমাজা এবং শব্দের শেষে দুই মাত্রা হয়।
এ ছন্দে সংযুক্ত বা অসংযুক্ত অক্ষর সমান ধরা হয়।
উদাহরণ : কেউ = কে (১)+-্টা (১) = ২ অক্ষর।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ (Blank Verse)
কবিতার পঙক্তির শেষে মিলহীন ছন্দকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলা হয়। অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতায় চরণের অস্তামিল থাকেনা | আমিত্রাক্ষর ছন্দ পয়ারেরই এক প্রকারভেদ । প্রতি পঙক্তিতে ১৪ অক্ষর থাকে। প্রতি পঙক্তি ৮+৬ প্ররবে বিভক্ত । অমিত্রাক্ষর ছন্দের অন্য নাম প্রবাহমান অক্ষরবৃত্ত ছন্দ । মাইকেল মধুসূদ দত্ত বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন।- Blank Verse অর্থ অমিত্রাক্ষর ছন্দ ।
"সনেট" ইটালিয়ান শব্দ । এর বাংলা রূপ চতুর্দশপদী কবিতা । সনেটে সাধারণত চৌদ্দ চরণ (লাইন) থাকে। একমাত্র অখন্ড ভাব-কল্পনা বা অনুভূতি যখন ১৪ অক্ষরে (কখনো কখনো ১৮ অক্ষরও ব্যবহৃত হয়) চতু্শ পঙক্তিতে একটি বিশেষ ছন্দোরীতিতে আত্মপ্রকাশ করে তখনই তাকে সনেট
বলে।
Sonnet is a poem of fourteen lines.
সনেটের দুটি অংশ -
ক) অষ্টক : প্রথম আট চরণকে অষ্টক বলে। .
খ) ষটক : শেষ ছয় চরণকে ষট্ক বলে। |
ইতালীয় কবি গেত্রার্ক এ ধারার আদি কবি। তিনি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সনেট রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সনেট রচনার ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আদর্শ ছিলেন ইতালীয় কবি পেত্রার্ক ৷ সনেটে মধুসূদন দত্তের দেশপ্রেম প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে।