‘গ্রিক’ ও ‘গ্রিস’ শব্দ দুটি যথাক্রমে জাতি ও দেশ। গ্রিসের ভৌগলিক পরিবেশ ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। এ অঞ্চলে অনেকগুলো পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালের মত। ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ হয়ে যায় দেশটি। এ ছোট দেশগুলোর নাম হয় নগর রাষ্ট্র। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিল স্পার্টা ও এথেন্স।
স্পার্টা ছিল একটি সামরিক নগর রাষ্ট্র। রাষ্ট্রনেতারা ছিল স্বৈরাচারী। পক্ষান্তরে প্রতিবেশী এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এথেন্সে রাষ্ট্র পরিচালনায় তখন দুইটি সংসদ ছিল। গোত্র প্রধানদের নিয়ে গড়া সংসদকে বলা হত ‘এরিওপেগাস’ এবং সাধারণ নাগরিকদের সমিতিকে বলা হত ‘একলেসিয়া’। এথেন্সে চুড়ান্তভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন পেরিক্লিস। পেরিক্লিস এথেন্সের ক্ষমতায় আসেন ৪৬০ খ্রিস্টাব্দে। স্পার্টা ও এথেন্স উভয় দেশ একে অন্যের শত্রু ছিল। এথেন্স তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি জোট গঠন করে। এর নাম হয় ‘ডেলিয়ান লীগ’ । অন্যদিকে স্পার্টা তাঁর বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে গঠন করে আরেকটি জোট। এ জোটের নাম হয় ‘পেলোপনেসীয় লীগ’। এক সময় এই দুই জোটের মধ্য যুদ্ধ বেধে যায়। ইতিহাসে এ যুদ্ধ ‘পেলোপনেসীয় যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ৪৬০ থেকে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মোট তিনবার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে চূড়ান্ত পতন ঘটে এথেন্সের। ৩৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স চলে আসে স্পার্টার অধীনে। এরপর নগররাষ্ট্র থিবস দখল করে নেয় এথেন্স। ৩৩৮ খিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপস থিবস অধিকার করে নেয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে দ্বিতীয় ফিলিপসের মৃত্যু হলে আলেকজান্ডার ম্যাসিডনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ব্যাবিলনে তাঁর মৃত্যু হয়।
ভৌগলিক অবস্থান
প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে গ্রিক সভ্যতার সাথে দুইটি সংস্কৃতির নাম জুড়িয়ে আছে। একটি ‘হেলেনিক’ (Hellenic) এবং অন্যটি ‘হেলেনিস্টিক’ (Hellenistic)। গ্রিসকে হেলেনীয় সভ্যতার দেশ বলা হয়। গ্রিসের প্রধান শহর এথেন্সে শুরু থেকেই যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তাকে বলা হয় হেলেনিক সংস্কৃতি। গ্রিস উপদ্বীপ ছিল এ সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। খিস্টপূর্ব ৩৩৭ অব্দ পর্যন্ত হেলেনিক সভ্যতা টিকে ছিল। এ সময় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র করে গ্রিক সংস্কৃতি ও অগ্রিক সংস্কৃতির মিশ্রণে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়। ইতিহাসে এ সংস্কৃতির পরিচয় হয় হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি নামে।
ধর্ম
গ্রিকরা বহুদেবতায় বিশ্বাসী ছিল। গ্রিকদের প্রধান দেবতা ছিলেন জিউস। দেবতা এপোলো ও দেবী এথেনাও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিকবাসী বিশ্বাস করত দেবতাদের বাস উত্তর গ্রিসে অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায়।
গ্রিক দেবী বা দেবতার নাম
পরিচিতি
আফ্রোডায়িট (Aphrodite)
ভালবাসা, রোমাঞ্চ এবং সৌন্দর্যের দেবী
অ্যাপোলো (Apollo)
সূর্য, আলো, চিকিৎসাবিদ্যা এবং সঙ্গীতের দেবতা
এরিস (Ares)
যুদ্ধদেবতা
আরটেমিস (Artemis)
শিকার, বন, উর্বরতা এবং চাঁদের দেবী
এথেনা (Athena)
প্রজ্ঞার দেবী (জিউসের কন্যা)
ডিমিটার (Demeter)
কৃষি বিষয়ক দেবী
হারমেস (Hermes)
ব্যবসা বিষয়ক দেবতা (রোমান নাম মারকারি)
হেরা (Hera)
বিবাহ বন্ধন অটুট রাখার দেবী। (জিউসের স্ত্রী)
জিউস (Zeus)
দেবতাদের রাজা
ট্রয়ের যুদ্ধ: গ্রিক পুরাণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হল ট্রয়ের যুদ্ধ। ট্রয়ের যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিলো তিনজন গ্রিক দেবীর মধ্যে ঝগড়ার কারণে। দেবী তিনজন হলেন এথেনা, হেরা এবং আফ্রেদিতি। ইনাদের মধ্যে আবার ঝগড়া লাগিয়েছিলেন আরেক দেবী ‘এরিস’। ঝগড়া বাঁধানোর কারণটাও যুক্তিযুক্ত – এরিস হলেন ঝগড়া আর বিশৃংখলার দেবী। তিনি একটা সোনালী আপেল দিয়েছিলেন এই তিন দেবীকে, যাকে মাছে মধ্যে ‘বিশৃঙ্খলার আপেল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং যার গায়ে খোদাই করা ছিল এই বাক্যটি ‘শ্রেষ্ট সুন্দরীর জন্য’। ফলে তিনজন দেবীর রূপ বিচারের সাহস পেলেন না। বাধ্য হয়ে জিউস সুন্দরীতমা নির্বাচনের ভার দিলেন ট্রয় নগরীর রাজপুত্র প্যারিসকে, যিনি ছিলেন আপদমস্তক একজন মানুষ। প্যারিস আফ্রোদিতিকে সবচেয়ে সুন্দরী বললেন এবং বিনিময়ে উপহার হিসেবে আফ্রোদিতির কাছ থেকে পেলেন জগদের শ্রেষ্ট সুন্দরীর ভালোবাসা। সে সময় সবচেয়ে সুন্দরী মানবী ছিলেন হেলেন, যিনি ছিলেন গ্রিসের স্পার্টার রাজা মেনেলাসের স্ত্রী। যুদ্ধটা শুরু হয়েছিলো যখন প্যারিস হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে পালিয়ে আসেন। মেনেলাস তার ভাই ‘মাইসিনে’ রাজ্যের রাজা আগামেমননকে আহ্বান করলেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য, হেলেনকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আগামেমনন তার অ্যাশিয়ান্স দল নিয়ে রওনা দিলেন ট্রয়ের উদ্দেশ্যে। প্রায় দশ বছর ধরে আগামেমমননের সৈন্যবাহিনী চারদিক দিয়ে ট্রয় নগরীকে ঘিরে রাখলো। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে মারা গেলেন অ্যাশিয়ান্স বীর অ্যাকিলিস, অ্যাজাক্স েএবং ট্রোজান বীর প্যারিস ও তার ভাই হেক্টর। একসময় গ্রিক যোদ্ধারা ‘ট্রোজান হর্স’ নামক একটা চাতুরীর আশ্রয় নিলো ট্রয় নগরীতে ঢোকার জন্য। ট্রোজানরা সাধারণ কাঠের ঘোড়া ভেবে ‘ট্রোজান হর্স’ কে ঢুকতে দিয়েই করে বসলো সবচেয়ে বড় ভুল।
এই কাহিনী এতোটাই মনোমুগ্ধকর এবং রোমাঞ্চকর যে, গ্রিক সাহিত্য কিংবা রোমান সাহিত্যের একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে ট্রয়ের যুদ্ধ। বিশেষ করে মহাকবি হোমারের দুটো মহাকাব্য-ইলিয়াড, ওডিসির মাধ্যমে এই রোমান্টিক ট্র্যাজেডি অমর হয়ে আছে। প্রাচীনকালে গ্রিসবাসীরা বিশ্বাস করতেন, ট্রয়ের যুদ্ধে একটা ঐতিহাসিক সত্য কাহিনী। তারা ভাবতেন, ঘটনাটি ঘটেছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ বা ১২০০ অব্দে। অনেকে ভাবতের , ট্রয় নগরী বা ট্রয়ের যুদ্ধ- উভয়ই বিষয়ই নিছক গল্পগাঁথা। কিন্তু ট্রোজান যুদ্ধের কাহিনী জনপ্রিয় হয়ে উঠে যখন ১৮৬৮ সালে হেইনরিখ শ্লিম্যান এবং ফ্রাঙ্ক ক্যালভার্ট নামক দুজন প্রত্নতাত্ত্বিক তুরস্কের হিসার্লিক অঞ্চলে ট্রয় নগরী খুঁজে পান।
দর্শন
গ্রিকদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল দর্শন চর্চায়। প্রথম দিকের বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন থ্যালেস। থ্যালেস কল্পকাহিনীর বদলে প্রথম সূর্যগ্রহণের প্রাকৃতিক কারণ ব্যাখ্যা করেন। ধীরে ধীরে গ্রিসে এক ধরনের যুক্তিবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। এঁদের বলা হতো সফিস্ট। প্রোতাগোরাস ছিলেন সফিস্ট সম্প্রদায়ের সবচেয়ে প্রাচীন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক। সৃষ্টির অজানা রহস্য নয়, বরং মানুষকে মানদন্ড বিবেচনা করে সে আলোকে দর্শনের আলোচনা ও ভাষাবিজ্ঞানে অবদানের জন্য সুবিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, `Man is the measure of all things’। সক্রেটিস ছিলেন গ্রিসের দার্শনিকের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান। অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ করায় গ্রিসের শাসক গোষ্ঠী ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ মহান দার্শনিককে হেমলক লতার তৈরি বিষ খাইয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ বাক্য ছিল, `Crito, I owe a cock to Asclepius, will you remember to pay the debt?’ (“ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াস আমাদের কাছে একটি মোরগ পায়, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভুলো না যেন”)। অ্যাসক্লেপিয়াস হচ্ছে গ্রিকদের আরোগ্য লাভের দেবতা। সক্রেটিসের শেষকথা থেকে বোঝা যায়, তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন মৃত্যু হলো আরোগ্য এবং দেহ থেকে আত্মার মুক্তি। সক্রেটিসকে ‘সব জ্ঞানীদের গুরু’ বলা হয়। সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি-
- Know thyself
- Slanderers do not hurt me because they do not hit me.
- Education is the kindling of a flame, not the filling of a vessel.
- I die, you to love-which is better only God knows.
- An unexamined life is not worth living.
- Knowledge is virtue (জ্ঞানই পূণ্য).
সক্রেটিসের ছাত্র দার্শনিক প্লেটো গ্রিক দর্শনকে চরম উন্নতির দিকে নিয়ে যান। তিনি তাঁর চিন্তাগুলো ধরে রাখেন ‘দি রিপাবলিক’ নামক গ্রন্থ রচনা করে। প্লেটো ৩৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দর্শনের স্কুল `Akademia’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্লেটোর বিখ্যাত উক্তি-
Virtue is Knowledge and Education is the main thing to acquire virtue
প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটলও একজন বড় দার্শনিক ছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘দ্যা পলিটিক্স’। তিনি ‘লাইসিয়াম’-এর প্রতিষ্ঠাতা। এরিস্টটল আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক ছিলেন।
এরিস্টটলের উক্তি-
- মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব।
- যে ব্যক্তি সমাজে বাস করেনা সে হয় দেবতা না হয় পশু।
- আইন হল পক্ষপাতহীন যুক্তি।
- সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।
- বল, শক্তি এবং লোভ লালসা মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে অসমভাবে বন্টিত।