মধ্যযুগের পরিধি ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত বলে বিবেচনা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে এই যুগের সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা
কাব্যের ইতিহাসে মধ্যবুগের অবসান ঘটে । ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকে ১৮৬০
সালে আধুনিকতার যথার্থ বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত এই “একশ' বছর বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষপূর্ণ
কোনো নিদর্শন বিদ্যমান নেই |
মধ্যযুগের শেষ আর আধুনিক যুগের শুরুর এই সময়টুকুকে 'অবক্ষয় যুগ” বলা হয়েছে । কারও কারও
মতে, এই সময়টা “যুগ সন্ধিক্ষণ' নামে আখ্যায়িত হওয়া উচিত । এ সময়ের একমাত্র প্রতিনিধি হচ্ছেন
কবি ঈশ্বরচন্দ্র শুপ্ত।
'অবক্ষয় যুগ' তথা যুগসন্ধিক্ষণের ফসল হিসাবে হিন্দুদের মধ্যে কবিগান ও মুসলমানদের মধ্যে পুঁথি
সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে । হিন্দু সমাজে কবিগানের রচয়িতাদের কবিওয়ালা এবং মুসলমান সমাজে মিশ্র
শতকের শেষার্ধে ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ।
অবক্ষয় যুগের বাংলা সাহিত্য কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে
১) কবিগান
২) পুঁথিসাহিত্য
কবিগান
কবিগান দুই পক্ষের বিতর্কের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতো। দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাই এর বেশিষ্ট্য।
কবিওয়ালারা ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। কবিওয়ালারা মূলত ছিলেন গায়ক, তারা অর্থের বিনিময়ে জনমনোরঞ্জন করতেন। কবিওয়ালাদের মধ্যে
অন্যতম ছিলেন গোঁজলা গুঁই, ভবানী বেনে, ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, কেষ্টা মুচি, এন্টনি ফিরিঙ্গি,
রামবসু, রাসু-নৃসিংহ, নিতাই বৈরাগী, শ্রীধর কথক, নীলমণি পাটনী, বলরাম বৈষ্ণব, রামসুন্দর স্যাকরা
প্রমুখ । 'গোঁজলা গুঁই' ছিলেন কবিগানের আদি গুরু ।
পুঁথিসাহিত্য
অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত 'আরবি-ফারসি' শব্দ মিশ্রিত ইসলামি চেতনাসম্পৃক্ত সাহিত্যকে পুঁথি
সাহিত্য বলা হয়। কেউ কেউ এই শ্রেণির কাব্যকে “আরবি-ফারসি' শব্দের প্রাচূর্যপূর্ণ ব্যবহারের জন্য
দোভাষী পুঁথি' নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এতে মাত্র দুটি ভাষার শব্দ নয় বরং করেকটি ভাষার
শব্দ (বাংলা-হিন্দি-আরবি-ফারসি-তুর্কি) ব্যবহার করা হরেছে। কলকাতার সন্তা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত
হয়ে এই ধারার কাব্য দেশময় প্রচারিত হয়েছিল বলে “বটতলার পুঁথি' নামেও একে চিহ্নিত করার
প্রচেষ্টা চলেছে।
পুথি সাহিত্যের কবি ফকির গরীবুল্লাহ : পুঁথি সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি ছিলেন ফকির গরীবুল্লাহ। মিশ্র
ভাষারীতিতে তার রচিত কাব্য হচ্ছে : “আমীর হামজা" (প্রথম অংশ), “জঙ্গনামা', ইউসুফ জোলেখা
'সোনাভান', “সত্যপীরের পুথি' । কবি কৃষ্ণরাম দাস : “রায়মঙ্গল' তার রচিত বিখ্যাত কাব্যের নাম। সৈয়দ হামজা : মিশ্র ভাষারীতিতে তার রচিত কাব্যগুলো হচ্ছে : “আমীর হামজা (২য় অংশ),"জৈগুনের পুঁথি" "হাতেম তাই" । তাঁর " মধুমালতী" কাব্যটি পুঁথি সাহিত্যের ধারার অনুসারী নয়, কবি সম্ভবত ফারসি কাব্য থেকে বঙ্গানুবাদ করে এ কাব্যের রূপ দেন।
এছাড়া মালে মুহন্দদ, মুহম্মদ খাতের, আবদুর রহিন নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । টপ্পাগান
টপ্পা এক ধরনের গান। কবিগানের সনসাময়িককালে কলকাতা ও শহরতলীতে টপ্পাগান লামে রাগ-
রাগিনী সংযুক্ত এক ধরনের ওস্তাদি গানের প্রচলন ঘটেছিল । হিন্দি টপ্পাগান এর আদর্শ । বাংলা
টপ্পাগানের জনক ছিলেন নিধু বাবু বা রামনিধি গুপ্ত। টপ্পা থেকেই আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার
সূত্রপাত বলে অনেকের ধারণা । নিধু বাবুর একটি গান ভাষা বন্দনায় চমকার নিদর্শন-
"নানান দেশের নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা ।
"বাংলার কাব্য বাংলার ভাষা মিটায় আমার প্রাণের পিপাসা,
সে দেশ আমার নয় গো আপন,
যে দেশ বাংলালি নেই ।
পাঁচালী গান
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পাচালী গান এদেশে জনপ্রিয় হয়েছিল। পাঁচালী রচয়িতাদের মধ্যে
শক্তিশালী কবি ছিলেন দাশরথি রায়। দাশুরায় নামে তিনি খ্যাত ছিলেন ।
শাক্ত পদাবলি বা শ্যামাসঙ্গীতঃ শাক্ত পদাবলি দিন্দু দেবী শ্যামা বা শক্তির উদেশে রচিত এক প্রকার ভক্তিগীতি। এর অপর নাম শাক্তগীতি। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শ্তকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি শাক্ত ধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং তাকে কেন্দ্র করেই শাক্তগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারা প্রচলিত হয় । আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন (আনুমানিক ১৭২০-১৭৮১) এতে জপ্রণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে" শাক্ত পদাবলি" বা শ্যামাসঙ্গীত" নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা প্রতিষ্ঠিত করেন।